অভিনয়জগতে ক্ষণজন্মা পুরুষ রাজু আহমেদের(১৯৪২-১৯৭২) আগমন নানাবিধ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট চলচিত্র অভিনেতা, স্বাধীন বাংলা বেতারের কণ্ঠযোদ্ধা এই রত্ন। অভিনয়শৈলী ও শিল্পবোধকে তিনি সৃষ্টিশীল সৌন্দর্যময়তায় সমন্বিত করে নতুন পথের অন্বেষণ করেন।======
একালের মত টেলিভিশন, মোবাইল, অনলাইন, ইন্টারনেট-এসব ১৯৭১ সালের বাংলাদেশে ছিলনা। মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর, দেশ-বিদেশের গতিবিধি, মনোভাব সম্পর্কে জানার প্রধান মাধ্যম ছিল রেডিও। রেডিও ছিল সর্বাধিক জনপ্রিয় গণমাধ্যম। কুষ্টিয়ার এক রত্ন তাঁর দরাজ ও ভরাট কণ্ঠের দ্বারা স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া খানের(কেল্লাফতে খাঁ-র চরিত্র) বাতাবরণে ঢেকে রাখা কুৎসীত মনের চেহারাকে উন্মোচিত করে দিয়েছিলেন রেডিও’র মাধ্যমে। পাকিস্তান সরকারের নোংরা মানসিকতা সম্পর্কে বাঙালি হৃদয়ে ভিন্নমাত্রার ছাপ রাখতে সহায়তা করেছিল এই দেশপ্রেমি যুবক রাজু অাহমেদ। অনিশ্চিত ভবিতব্য নিয়ে জাতীয় নেতৃবৃন্দ যখন দায়িত্বশীল ভূমিকায় রয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধারা যখন ভারতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, হাজারো দামাল ছেলেরা যখন দেশিয় অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানেরর সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশকে মুক্ত করতে লড়াই করছেন-ঠিক সেই সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে রাজু আহমেদ ভিন্নধারার চরিত্রের রূপায়নে জানান দিচ্ছেন যে, এটাই বাস্তবচিত্র। “বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো”। -প্রকৃত ম্যাসেজ (বার্তা) বুঝতে পেরেছিল স্বাধীনতাকামী বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ।এ প্রসঙ্গে তাঁর অনুজ গবেষক ও প্রাবন্ধিক লালিম হক বলেন,” এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর প্রেরণা যুগিয়েছিল মুক্তিপাগল মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়ে।”=====
ঘটনাটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালিন সময়ের। সবাই যখন বাংলাদেশের হয়ে অস্ত্র নিয়ে লড়ছেন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে; রাজু আহমেদ কণ্ঠযোদ্ধা হয়ে দেশের হয়ে লড়াই করছেন সেই সময়। এ প্রসঙ্গে গবেষক ও প্রাবন্ধিক ম. মনির উজ্ জামান বলেন,” মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত রূপকধর্মী সিরিজ নাটক জল্লাদের দরবার-এ কেল্লাফতে খাঁর চরিত্রে অভিনয় করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।”– সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব আল মাসুম বলেন,”স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কল্যাণ মিত্রের রচনায় ‘জল্লাদের দরবার’ নাটকে ইয়াহিয়া খানের চরিত্রে(জল্লাদের) রাজু আহমেদ অভিনয় করতেন। সাংঘাতিক জনপ্রিয়তা পায় নাটকটি।”– রাজু আহমেদ স্বৈরাচারী সরকারপ্রধানের মুখোশ খুব ভালোভাবেই উন্মোচিত করতে পেরেছিলেন। অভিনয়শৈলী, শব্দপ্রয়োগের চমৎকারিত্ব ও কণ্ঠের সুনিপুণ প্রক্ষেপনে সমন্বিত করেছিলেনন রাজু আহমেদ। তাঁর অভিনয়েরর মধ্যে ভাবাবেগের কারুকার্যময়তা অার কল্যাণমিত্রের লেখনিশক্তি বিস্ময়াভিভূত করেছিল শ্রোতামণ্ডলীকে।========
উপমহাদেশের প্রখ্যাত অভিনেতা, শিল্পী ও কণ্ঠমুক্তিযোদ্ধা রাজু আহমেদ কুষ্টিয়া শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মায়ের নাম সখিনা খাতুন। একজন রত্নগর্ভা মা। পিতা খোন্দকার লুৎফেল হক ছিলেন অত্যন্ত গুণী ব্যক্তিত্ব। কুষ্টিয়ার খ্যাতিমান উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পী, অভিনেতা ও আইনজীবী ছিলেন।
ছিলেন উচ্চমানের বেহালাবাদক। বড়সন্তান রাজু আহমেদ ও অন্যান্য সন্তানদের তিনি অাদর্শবান মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। এজন্যই সকল সন্তানই যোগ্যতাসম্পন্ন হয়েছেন। রাজু আহমেদের প্রকৃত নাম খোন্দকার মাসুদুল হক। রাজু আহমেদ ব্যাপক পরিচিত ও উচ্চারিত এক নাম। সাংস্কৃতিক পরিবেশেই বেড়ে উঠেন রাজু। ছেলেবেলা থেকেই মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত ও সৃষ্টিশীল ছিলেন। কুষ্টিয়ার মুসলিম হাইস্কুল ও সরকারি কলেজে পড়াশোনার পর করাচীতে চারুকলা বিষয়ে বিদ্যা অর্জন করেন। পুরস্কার লাভ করেন কারাচীর আর্ট প্রতিযোগিতায়। সারাজীবন সৃষ্টিশীল কাজের সাথেই যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালে আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে সারা বাংলাদেশের মানুষ তাঁর জন্য খুব কেঁদেছিলো। আমরা তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই