বিশেষ প্রতিবেদক: সময় বদলেছে, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাও প্রবেশ করেছি ইন্টারনেটের যুগে। পৃথিবী যেন আজ হাতের মুঠোয়। শুধু কথা বলার জন্য ছোট মোবাইল ফোন যেন ব্যবহার হচ্ছে না। সরলমনা বাবা-মার কল্যাণে শিশু, কিশোর, কিশোরীদের হাতেও এখন স্মার্টফোন। আদুরে সন্তানদের আবদার পূরণ করতে গিয়ে বাবা-মাকে ফোন, ইন্টারনেটের ডাটা ও গেম কিনতে গুণতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ। দেশে শিশু-কিশোরদের প্রিয় গেম এখন পাবজি, ফ্রি ফায়ার। ফ্রি ফায়ার গেম ২০০ ডায়মন্ড ১৬৫ টাকা, ৫২০ ডায়মন্ড ৪১৫ টাকা, ১০৬০ ডায়মন্ড ৮৪০ টাকা। এভাবে ৫৬০০ ডায়মন্ড ৩৯৫০ টাকা (কম-বেশি) পর্যন্ত ফ্রি ফায়ার গেম কিনছে শিশু-কিশোররা। এই অর্থ কোনও না কোনওভাবে অভিভাবকদের নিকট থেকে নিচ্ছে তারা। ছোটবেলা থেকে ব্যয়ের সাথে এভাবে পরিচিত হয়ে উঠার ফলে সঞ্চয়ী মনোভাব তাদের কমে যাচ্ছে। সঞ্চয়ী মনোভাব কমে গেলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যুবকদের চাকুরির পিছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার যে পরামর্শ দিয়েছেন তা ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
অভিভাবকদের পকেট খালি করার ফলাফলটা যদি ভালো হতো তবে কোনও কথাই ছিলনা। স্মার্টফোন হাতে পেয়ে শিশু, কিশোর, কিশোরীদের চোখ এখন মোবাইলের পর্দার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আসক্ত হয়ে পড়ছে তারা ভিডিও গেম, ফেসবুকে। হয়তোবা অভিভাবকদের চোখ এড়িয়ে পর্ণোগ্রাফিও দেখছে কেউ কেউ, যা চিন্তার বিষয়। এগুলোর প্রতি আসক্তির ফলে পড়াশোনার টেবিলে আর মন যেন স্থির রাখতে পারছে না তারা। জেএসসি, এসএসসি বা সমমান পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেতে হবে বাবা-মার এমন শর্তে কাঙ্খিত ফলাফল অর্জনের পর অনেক বাবা-মাই তাদের মেধাবী সন্তানটির হাতে তুলে দিচ্ছে দানবরূপী স্মার্টফোন, এমন চিত্রও সমাজে ঢের দেখা যায়।
করোনাভাইরাসের (কোবিড-১৯) কারণে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এই অবসর সময়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা মোবাইলে গেমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। প্রযুক্তির হাত ধরে কুষ্টিয়া জেলার ছয়টি উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মোবাইলে ইন্টারনেট চলে গেছে। আর সেই সুবাদে স্থানীয় কিশোর, তরুণ ও যুবকরা ফ্রি-ফায়ার গেমসে ঝুঁকে পড়ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে উঠতি বয়সের শিক্ষার্থীরা ও পুরো যুব সমাজ দিন দিন ফ্রি-ফায়ার নামক গেম খেলছে। যে সময় তাদের ব্যস্ত থাকার কথা শিক্ষা, বই পাঠ, ও খেলা ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে, সে সময়ে তারা প্রযুক্তির কল্যাণে ঘরকুনো হয়ে এসব নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে আছে। ১০ বছর থেকে ২৫ বছর বয়সী এসব শিশু, কিশোর ও তরুণরা প্রতিনিয়ত স্মার্ট ফোন দিয়ে গেমে আসক্ত হচ্ছে। এসব গেম থেকে শিক্ষার্থী বা তরুণ প্রজন্মকে ফিরিয়ে আনতে না পারলে বড় ধরনের ক্ষতিতে পড়ার সম্ভাবনা দেখছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফ্রী ফায়ার গেমে আসক্ত এক যুবক জানান, প্রথমে তার কাছে ফ্রী ফায়ার গেম ভালো লাগত না। কিছু দিন বন্ধুদের দেখাদেখি খেলতে গিয়ে এখন তিনি আসক্ত হয়ে গেছেন। এখন গেমস না খেললে তার অসস্তিকর মনে হয়।
স্থানীয় দশম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী জনায়, সে পূর্বে এসব গেমস সম্পর্কে কিছু জানতো না। এখন সে নিয়মিত এসব গেমস খেলে। মাঝে মধ্যে গেমস খেলতে না পারলে মুঠোফোন ভেঙে ফেলার ইচ্ছাও হয় তার। এসব গেমস যে একবার খেলবে, সে আর ছাড়তে পারবে না বলে দাবি করে ওই শিক্ষার্থী।
মোবাইল গেমের আসক্তিকে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বলে আখ্যা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটি এই প্রথমবারের মতো এটাকে একটা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করলো। যেটাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোগব্যাধির শ্রেণি বিন্যাসের তালিকায় ‘গেইমিং রোগ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এবিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষাক্ষীর মায়ের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, করোনায় সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী আসক্ত হচ্ছে এ খেলায়। শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা। কিন্তু লেখাপড়া বাদ দিয়ে তারা ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে ফ্রি-ফায়ার নামক গেম নিয়ে ব্যস্ত। যা শিক্ষার্থীকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তার ছেলেও এই গেমে আসক্ত।
এসব গেম মাদকদ্রব্যর নেশার চেয়ে ভয়ঙ্কর উল্লেখ করেন একজন আইনজীবী বলেন, ‘দীর্ঘ দিন যাবৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে কিশোর, তরুণ ও যুবকরা হতাশায় দিন পার করার কারণেই ভয়ঙ্কর ওইসব গেমে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর গেমে আসক্তির কারণে তারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। বাড়ছে কিশোর অপরাধ।’ তাই এই সমস্যা থেকে আমাদের সন্তানদের বাঁচাতে হলে অভিভাবকদের পাশাপাশি সমাজের সচেতন মহল, শিক্ষক এবং প্রশাসনকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
এ ব্যাপারে একজন শিক্ষক বলেন, ‘আমাদের সময় আমরা অবসর সময়টা বিভিন্ন খেলাধুলার মধ্য দিয়ে পার করতাম, কিন্তু এখনকার যুগে এ প্রজন্মের সন্তানদের দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। উপজেলার গ্রামগঞ্জে মোবাইলে গ্রুপ গেম মহামারি আকার ধারণ করেছে। শিক্ষার্থীরা অনেকে পড়ার টেবিল ছেড়ে খেলছে এসব গেম, কখনো ইন্টারনেটে বিভিন্ন সাইটে পর্ন ছবি দেখছে। এতে একদিকে তাদের ভবিষ্যৎ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে কিশোর অপরাধসহ বিভিন্ন সামাজিক নানা অপরাধ বেড়েই চলছে।’
কিশোর-কিশোরীদের মা-বাবাসহ সমাজের সবারই খেয়াল রাখতে হবে, সিক্ষার্থীরা যেন মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল আসক্ত না হয়। অভিভাবক, সচেতন মহল প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থানে সচেতন হলে তরুণ ও যুব সমাজকে এ আসক্তি থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ শওকত কবির।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘বর্তমানে এ ফ্রি-ফায়ার নামক গেমে সবচেয়ে বেশি আসক্ত হচ্ছে স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। অনেকেই এর খেলার পেছনে অর্থ ব্যয় করছেন।’ অভিভাবকসহ সমাজের সবাই মিলে এ বিষয়ে তদারকি না করলে ভবিষতে ফ্রি ফায়ার নামক গেম মাদকের চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর হতে পারে বলে মনে করেন তিনি। তাই এই বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে আহ্বান জানান ইউএনও।
আবার, অনেক অপরিণামদর্শী মায়েরা শিশুকে খাবার খাওয়াতে, কান্না থামাতে ল্যাপটপ, মোবাইল ফোনে ভিডিও গেমস দেখার অভ্যাস করাচ্ছেন। এতে করেও শিশুরা ক্রমান্বয়ে ঝুঁকে পড়ছে ভিডিও গেমের প্রতি। তাছাড়া, আগে যেখানে শিশুরা অন্য শিশুদের সাথে খেলাধুলা, ধুলোবালি আর কাদায় মাখামাখি করতো, বর্তমান মায়েরা সেখানে অন্য শিশুদের সাথে মিশলে খারাপ হবে, ধুলোবালি ও কাদায় মাখামাখি করলে শরীর, জামা নষ্ট হচ্ছে বলে ধমকও দেন। মায়ের বকুনি থেকে বাঁচতে শিশুরা মাউসের বাটন, ল্যাপটপ কিংবা মোবাইল ফোনেই গেম খেলে খেলাধুলার আনন্দ খুঁজে ফিরছে এবং ধীরে ধীরে তারা আসক্ত হয়ে পড়ছে ভিডিও গেমসের উপর। বঞ্চিত হচ্ছে শিশু-কিশোররা তাদের শৈশব-কৈশোরের আনন্দ থেকে।
শিশু ও কিশোরদের ভিডিও গেমস, ফেসবুক, ইউটিউব দেখার আসক্তিকে পুঁজি করে পুঁজিপতিরা লুটে নিচ্ছেন অর্থ, গড়ছেন সম্পদ। মোবাইল অপারেটরগুলোও এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন ইন্টারনেট প্যাকেজের সময় বেঁধে দিয়ে। নির্ধারিত সময় চলে গেলেই ডাটা কেটে নেয়া হবে, তাই ডাটা শেষ করার জন্য শিশু, কিশোররা চালায় বিরতিহীন প্রচেষ্টা। পকেট খালি হচ্ছে অভিভাবকদের, নষ্ট হচ্ছে শিক্ষার্থীদের জীবন গড়ে তোলার মূল্যবান সময়। ফোনে চার্জ অথবা ডাটা না থাকলে দেখা দিচ্ছে তাদের মধ্যে অস্থিরতা। টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে অথবা শিক্ষা উপকরণ কেনার নাম করে বাবা-মা অথবা অভিভাবকের নিকট থেকে অর্থ নিয়ে কিনছে গেম। পরিণামে ছোটবেলা থেকে রপ্ত করছে মিথ্যে বলার অভ্যাস। দেখা দিচ্ছে খিটখিটে মেজাজ, চোখের সমস্যা, বাবা-মায়ের সাথে করছে দুর্ব্যবহার।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়ন করছে এমন শিক্ষার্থীরাও তাদের বাবা-মায়ের ফোনে খুলছে ফেসবুক আইডি, তৈরি করছে গ্রুপ, করছে চ্যাটিং আর কিনছে গেম। ভাবা যায় ! শুধু তাই নয়। গেম কিনতে হলে নাকি ফেসবুক অথবা ই-মেইলের পাসওয়ার্ডও দিতে হয় গেম বিক্রেতাদের নিকট। কি সর্বনাশা কথা! এতে করে ভয়াবহ বিপদে পড়তে পারে শিশু, কিশোরদের সাথে অভিভাবকরাও। হতে পারে তারা ব্ল্যাকমেইলের শিকার। সামষ্টিক অর্থনীতিতে বলা হয়েছে, ‘যা তুমি জান না তা তোমাকে আঘাত বা প্রভাবিত করে না। কিন্তু যা তুমি জান তা তোমাকে ভাবিয়ে তোলে।’ এ কথাটির সাদৃশ্য রয়েছে শিশু-কিশোররা ভিডিও গেমের সাথে যে পরিচিত হয়ে উঠেছে তা থেকে বেড়িয়ে আসা বেশ কঠিন হবে তার সাথে। এ আসক্তি থেকে দেশের প্রজন্মকে রক্ষায় বাবা-মাসহ অভিভাবকবৃন্দ যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারলে তবেই মিলবে সমাধান।
স্মার্টফোন ব্যবহার ও ভিডিও গেম খেললে শিশু-কিশোররা কি ধরণের সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে সেই বিষয়টি স্পষ্ট করে জানিয়েছেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বলেন, শিশু ও কিশোররা স্মার্টফোন ব্যবহার ও ভিডিও গেম খেললে তাদের চোখের দৃষ্টি কমে যাবে। এ ছাড়া তাদের মস্তিষ্ক বিকাশেও বিঘ্ন ঘটবে।